শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা

সাঁতার

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা - অ্যাথলেটিকস ও সাঁতার | NCTB BOOK

সাঁতার একটি অতি প্রাচীন ক্রীড়া। প্রাচীন যুগে মানুষ বাঁচার জন্য সাঁতার শিখেছে। এজন্য কোনো নিয়মকানুন কলাকৌশলের প্রয়োজন ছিল না। পরবর্তীকালে সুস্বাস্থ্য গঠন ও নির্মল চিত্ত বিনোদনের জন্য সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষেকে আনন্দ দিয়ে আসছে। বর্তমানে যে ধরনের সাঁতার আমরা দেখতে পাই সে সাঁতার প্রথমে ইংরেজরা শুরু করেন। ইংরেজরা প্রথমে ব্রেস্ট স্ট্রোক ও সাইড স্ট্রোক দিয়ে সাঁতার শুরু করেন। ১৮৭৩ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার অনুষ্ঠিত হয়। আস্তে আস্তে সারা বিশ্বে এর প্রসার ঘটতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ অ্যামেচার সুইমিং ফেডারেশন গঠিত হয়। তখন থেকে এই ফেডারেশন বাংলাদেশে সাঁতারের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
 

সাঁতারের কলাকৌশল : প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার চার রকমের। 

১. ফ্রি স্টাইল (Free style), ২. ব্যাক স্ট্রোক বা চিৎ সাঁতার (Back stroke), ৩. ব্রেস্ট স্ট্রোক বা বুক সাঁতার (Breast stroke), ৪. বাটার ফ্লাই বা প্রজাপতি সাঁতার (Butterfly)।

ক. ফ্রি স্টাইল বা মুক্ত সাঁতার : এই সাঁতারে একজন প্রতিযোগী যে কোনো স্টাইলে সাঁতার কাটতে পারে। তবে কীভাবে সাঁতার কাটলে দ্রুত যাওয়া যায় তা সাঁতারু বার বার অনুশীলন করে আয়ত্তে আনতে পারে। এজন্য দেহের অবস্থান, পা ও হাতের কাজ, শ্বাস-প্রশ্বাস- এইসব প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
 

১. দেহের অবস্থান : দেহটাকে উপুড় করে পানির সমান্তরালে রাখতে হবে। মাথা পানির সামান্য উপরে থাকবে। তবে পানির মধ্যে মাথার অবস্থান কখনো পানির উপর তুলে, আবার কখনো ঘাড় কাত করে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করতে হয়।
 

২. পায়ের কাজ : পায়ের কাজ কোমর থেকে শুরু হয় এবং সামনে এগোনোর জন্য ডান ও বাম পা একের পর এক উঠা-নামা করে। হাঁটুর কাছে পা সামান্য ভাঁজ করা অবস্থায় থাকে এবং পায়ের পাতা সোজা থাকে। বাম পায়ের গোড়ালি পানির উপর উঠে না। পায়ের পাতা দিয়ে যখন পানিতে চাপ দেওয়া হয় তখন পায়ের পাতা ১২-১৮ ইঞ্চি পরিমাণ পানির নিচে যেতে পারে। পানির মধ্যে দু'হাত একবার ঘুরে আসার সময় দুই পা পানির মধ্যে ৬ বার উঠা-নামা করবে। পায়ের কাজকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়- ক. উপরে কিক, খ. নিচে বিট।
 

৩. হাতের কাজ : পানিতে দুই হাত একের পর এক মাথার সামনে ফেলতে হবে। এক হাত পানি কেটে শরীরের পাশ দিয়ে কোমরের কাছে যাবে, ঐ সময় কনুই সামান্য ভাঁজ হবে। হাতটি পানির উপর উঠা মাত্র অপর হাত মাথার সামনে পানিতে গিয়ে পড়বে। পানিতে হাত পড়ার সাথে হাত দিয়ে পানি কেটে শরীরকে সামনে নিতে হবে। হাত ও পায়ের সমন্বিত কাজের ফলে সাঁতারুর গতি বৃদ্ধি পায়।
 

৪. শ্বাস প্রশ্বাস : সাঁতার কাটার সময় মাথাটাকে ঘুরিয়ে পানির উপর মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া ও নিঃশ্বাস ছাড়া হয়। যে হাত পানির উপরে থাকবে সেদিকে মাথা ঘুরিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস- প্রশ্বাস ক্রিয়া চালাতে হবে। তবে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে মুখ পানির মধ্যে ঘুরে যাওয়ার সময় ।
খ. ব্যাক স্ট্রোক বা চিৎ সাঁতার : পানির উপর পিঠ রেখে চিৎ হয়ে পিছনের দিকে সাঁতার কাটতে হয় বলে একে চিৎ সাঁতার বলে।
 

১. দেহের অবস্থান : পানিতে শরীরকে চিৎ করে রাখতে হবে। সাধারণত মাথাটাকে পানির ভিতর রাখতে হয়। এর ফলে শরীর পানির উপর সমান্তরাল অবস্থায় থাকে। নাক পানির মধ্যে না ডুবে পানির উপরে থাকবে এবং দৃষ্টি থাকবে পায়ের গোড়ালির দিকে।

২. গায়ের কাজ : মুক্ত সাঁতার বা ফ্রি স্টাইলের মতো চিৎ সাঁতারে পায়ের কাজ করা হয়। মুক্ত সাঁতারে পানির উপর উপুড় হয়ে দু'পা পানির মধ্যে থেকে একের পর এক উঠানামা করে। ঠিক তেমনি চিৎ সাঁভারে পানিতে চিৎ হয়ে থেকে দু'পা পানির মধ্যে উঠা নামা করবে। এ সময় পায়ের পাতা সোজা থাকবে ।
 

৩. হাতের কাজ : এক হাত কানের পাশ দিয়ে সোজা পিছনে নেওয়ার পর হাতের তালু ও আঙ্গুল দিয়ে পানি কেটে শরীরের পাশে নিয়ে আসবে তখন অপর হাত একইভাবে পিছনে গিয়ে পড়বে। এভাবে একের পর এক হাত পিছনে ও পাশে আসবে এবং এর সাথে পায়ের কাজ সমন্বিত হবে।
 

৪. শ্বাস-প্রশ্বাস : যেহেতু পানির উপর চিৎ হয়ে থাকার জন্য মুখ উপরের দিকে থাকবে তাই শ্বাস-প্ৰশ্বাস স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে।

গ. ব্রেস্ট স্ট্রোক বা বুক সাঁতার : পানিতে বুকের উপর ভর করে এই সাঁতার কাটতে হয় বলে একে বুক সাঁতার বলে। 

১. দেহের অবস্থান : দেহ থাকবে পানির উপরিভাগ সমান্তরালে। দেহের পিছনের অংশ কিছুটা পানির মধ্যে থাকে। মাথা থাকবে পানির উপরে। হাতের ও পায়ের কাজের শেষে শরীর যখন সামনে এগোবে তখন নাক ও মুখ পানির কিছুটা নিচে যাবে।
 

২. পায়ের কাজ : দুই পা কে এক সাথে রাখতে হবে। দুই হাত মাথার সামনে লম্বা করে ফেলে দুই হাত দিয়ে শরীরের দুইপাশে পানি কেটে টেনে আনতে হবে। এ সময় দুই হাঁটু ভাঁজ করে পানির নিচে যাবে, আর দু' গোড়ালি এক সাথে কোমরের কাছাকাছি এসে সজোরে পানিতে ধাক্কা দেবে।
 

৩. হাতের কাজ : দুই হাত এক সাথে সামনে প্রসারিত করতে হবে। দুই হাত এক সাথে পানি কেটে শরীরের দু'দিকে আসার সময় কনুই সামান্য ভাঁজ হবে। পানি কেটে আসার পর আবার মুখের সামনে দুই হাত একত্রিত হয়ে সামনে চলে যাবে। এ সময় নাক, মুখ ও কপালের কিছুটা পানির মধ্যে থাকবে।
 

৪. শ্বাস প্রশ্বাস : মুখের সামনে দুই হাত প্রসারিত করার পর যখন শরীরের দু'পাশে পানি কেটে আসবে তখন মুখ পানি থেকে উপরে উঠিয়ে শ্বাস নেবে এবং পানির মধ্যে নিঃশ্বাস ছাড়বে।
 

ঘ. বাটার ফ্লাই স্ট্রোক বা প্রজাপতি সাঁতার : চার প্রকার সাঁতারের মধ্যে বাটার ফ্লাই স্ট্রোকের সাঁতার সবচেয়ে কঠিন। এতে সাঁতারুকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এর কলাকৌশল আয়ত্ত করতে সাঁতারুকে অনেক অনুশীলন করতে হয়।
 

১. দেহের অবস্থান : অন্য সকল স্ট্রোকের মতো দেহ যথাসম্ভব পানির উপর সমান্তরাল অবস্থানে থাকবে। যেহেতু শরীরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় এবং মাথা উঠিয়ে শ্বাস নিতে হয় তাই শরীরের পিছনের অংশটুকু একটু পানির নিচে থাকে।
 

২. পায়ের কাজ : দুই হাত জোড়া অবস্থায় থাকবে। কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত যত বেশি নমনীয় হবে, তত জোরে পানিতে জোড় পায়ে আঘাত করা যাবে। দুপায়ের হাঁটু একটু ভেঙ্গে নিচে ও পিছনে পানিতে ধাক্কা দিতে হবে। ডলফিন মাছ যেভাবে লেজের সাহায্যে পানিতে ধাক্কা দিয়ে চলে সেভাবে পায়ের এই ধাক্কাকে ডলফিন কিক বলে।

৩. হাতের কাজ : দুই হাত একসাথে মাথার সামনে নিক্ষেপ করতে হয়। দুই হাত এক সাথে মাথার সামনে চাপ দিয়ে শরীরকে সামনে এগিয়ে নিতে হয়। এর সাথে পায়ের ডলফিন কিকের সমন্বয় ঘটবে। পানির ভিতর থেকে দুই হাত উঠিয়ে যখন সামনে ফেলা হয় তখন খানিকটা প্রজাপতির পাখার মতো দেখতে মনে হবে। তাই একে বাটারফ্লাই স্ট্রোক নাম দেওয়া হয়েছে ।
 

৪. শ্বাস-প্রশ্বাস : একবার হাতের কাজ সম্পন্ন হলে দুইবার পায়ের ডলফিন কিক সম্পন্ন হয়। হাতের সঞ্চালনের কাজ এবং দ্বিতীয় বার পায়ের কিকের সময় মুখ দিয়ে শ্বাস গ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়। তখন মাথা থাকে পানির উপরে ।

 

ঘূর্ণন (Turning) : 

ঘূর্ণন সাঁতারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঘুরতে দেরি হলে সময় বেশি লাগে। ঘূর্ণনের সময় সাঁতারের গতি কমানো যাবে না। একজন সাঁতারুকে ঘূর্ণনের সময় পর্যায়ক্রমে নিচের কাজগুলো করতে হয়-
১. দেয়ালের কাছে গিয়ে ঘূর্ণনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
২. ঘূর্ণনের কৌশল মোতাবেক শরীরকে ঘোরাতে হবে।
৩. হাঁটু বাঁকা করে পদদ্বয় দেয়ালের কাছে স্থাপন করতে হবে।
৪. পায়ের পাতা স্থাপন ঠিকমতো হলেই শরীরকে ঘোরাতে হবে।
৫. দেয়ালের সাথে পা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। ৬. গ্লাইডের সময় শরীরকে সোজা রেখে অগ্রসর হতে হবে।
৭. পায়ের ও হাতের কাজ শুরু করতে হবে।

 

সাঁতারের নিয়মাবলি
১. সুইমিং পুলের দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার ও প্রস্থ ২১ মিটার হবে।

২. সুইমিং পুলে লেন থাকে ৮টি, লেনের প্রস্থ ২.৫০ মিটার, পানির গভীরতা ১.৮ মিটার। ৩. আরম্ভ স্থান অপিচ্ছিল হবে এবং পানি থেকে ০.৫০ -০.৭৫ মিটার উপরে থাকবে।
৪. আরম্ভকারী আরম্ভের সময় নিচের শব্দগুলো উচ্চারণ করবেন টেক ইউর মার্ক, সেট, পিস্তলের আওয়াজ।
৫. চিৎ সাঁতার বাদে অন্য সাঁতারগুলো ডাইভ দিয়ে শুরু করতে হবে। ৬. হিটে যে ১ম ও ২য় হবে তাদেরকে ৪ ও ৫ নং লেন দিতে হবে।
৭. ফ্রি স্টাইল ও চিৎ সাঁতারে এক হাত দিয়ে স্পর্শ করে সাঁতার শেষ করা যায় কিন্তু বুক ও প্রজাপতি সাঁতারে দু'হাত দিয়ে ফিনিশিং দেয়াল স্পর্শ করতে হয়।
৮. যদি কোনো সাঁতারু নির্দিষ্ট স্টাইলে না সাঁতরিয়ে অন্য স্টাইলে সাঁতরায় তাহলে সে অযোগ্য হবে। 

৯. ব্যাক স্ট্রোক সাঁতারের সময় দেয়ালের সাথে যে হাতল আছে তা ধরে পা দ্বারা পুশ করে চিৎ হয়ে আরম্ভ করতে হবে।
১০. একজন সাঁতারু লেন পরিবর্তন করতে পারবে না বা অন্য সাঁতারুকে বাধা প্রদান করতে পারবে না।
 

রিলে : 

রিলে দুই প্রকার। ক. মিডলে রিলে খ. ব্যক্তিগত মিডলে রিলে ।
 

মিডলে রিলে : চারজন সাঁতারু যখন চারটি স্টাইলে একই দূরত্বে সাঁতার দেয় তাকে মিডলে রিলে বলে। মিডলে রিলের ক্রম- ১. চিৎ সাঁতার, ২. বুক সাঁতার, ৩. প্রজাপতি সাঁতার, ৪. মুক্ত সাঁতার।
 

ব্যক্তিগত মিডলে : একজন সাঁতারু যখন একাই ৪টি স্টাইলে সাঁতার দেয় তাকে ব্যক্তিগত মিডলে রিলে বলে। এ রিলের ক্রম হলো- ১. প্রজাপতি সাঁতার, ২. চিৎ সাঁতার, ৩. বুক সাঁতার, ৪. মুক্ত সাঁতার।

 

 

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion